----------তনয়া অঝোড়ে কান্না করছে।
আয়াত কিছুক্ষন তনয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে রুমে চলে গেলো। কারন আয়াত নিজেও নিজের চোখের জল আটকে পাড়ছে না। তাই তনয়ার কাছ থেকে দূরে চলে আসলো। রুমে এসে বার নিজের চোখের নোনা তরল গুলোকে মোছার বৃথা চেষ্টা করছে। আর বলছে যাকে এত ভালোবাসি তাকে নিজেই এভাবে কাঁদাচ্ছি? মাঝে মাঝে মনে হয় ওকে সব সত্যি কথা বলে দি। কিন্তু পরোক্ষনেই ওর দেয়া কষ্টগুলো মনে পরে। আর ওর উপর থেকে ভালোবাসার পরিবর্তে রাগ এসে পড়ে।
তনয়া বারান্দায় দাড়িয়ে কান্না করছে আর ভাবছে। এর ঘরটার প্রত্যেকটা কোনা আমার চেনা। এ ঘরটা যে সাঁজিয়েছে সে আমার স্বপ্ন গুলো জানে। ঘরের প্রত্যেকটি কোনা আমার মনের মত করে সাজানো। এমনকি বারান্দার ফুল গাছ গুলোও আমার পছন্দের। গাছ সাজানোর ধরনগুলো পর্যন্ত আমার বলা। কিন্তু এ কথা গুলোতো আমি শুধু মাত্র একজনকে বলেছিলাম। কিন্তু সে তো আয়াত নয়? এক বছর তিন মাস ছয়দিন আগে আমি কথাগুলো তাকে বলেছিলাম।
কিন্তু সে তো আয়াত নয় ? নাকি সে আয়াতকে চেনে? নাকি আয়াত তাকে চেনে? কি করে সম্ভব? কি করে কেউ অন্য একজনের স্বপ্ন গুলোকে এভাবে কপি করতে পারে? সে অবশ্য আমায় বলেছিলো আমার ঘর আমি তোমার মনের মত করে সাঁজাবো। তনয়া নিজের চোখের জলটা মুছতে মুছতে বললো-----
তনয়াঃ নাহ আমাকে আরো শক্ত হতে হবে? নিজের উপর আস্থা রাখতে হবে! আয়াত কে? তা যে ভাবেই হোক জানতে হবে? আর আয়াতের সাথে তার কি সম্পর্ক সেটা জানতে হবে? তার আগে আমার নীলের সাথে কথা বলতে হবে? কারন ওই পারবে আমায় সঠিক সত্যি জানতে? এসব ভাবছে এর মধ্যে আয়াত তনয়াকে ডাক দিলো।
আয়াতঃ তনয়া খাবে এসো।
তনয়াঃ আপনি খেয়ে নেন আমি পড়ে খাবো।
আয়াতঃ এটা কি তনয়া খারাব নিয়ে জেদটা তোমার এখনো আছে?
তনয়াঃ কি বললেন?
আয়াতঃ কই কিছু না খেতে বসো।
সালেহা আন্টি (ওদের বাসায় কাজ করে) খাবার নিয়ে এসো। আয়াত তনয়াকে খাবার তুলে দিচ্ছে।
তনয়া মনে মনে বলছে ওনাকে মানষিক ডাক্তার দেখান উচিৎ। এই রাগ এই ভালাবাসা। কনফিউজিং পারসোনালিটিস।
আয়াতঃ হা করো।
তনয়াঃ আমার হাত আছে। বলে নিজেই তুলে খাওয়া ধরলো।
আয়াত মুচকি হাসি দিয়ে খেতে বসলো। কিছুটা খাবার পর তনয়ার পচন্ড হাঁচি কাঁশি শুরু হলো।
আয়াত তনয়ার পিঠে মালিশ দিয়ে পানি খাওয়াচ্ছে। কিন্তু হাঁচি কমছেই না। হঠাৎ আয়াত সালেহাকে ডাক দিলো। আন্টি আন্টি!
সালেহাঃ হ্যা আয়াত বাবা!
আয়াতঃ আজকের খাবারে কি মাশরুম আছে?
সালেহাঃ হ্যা !
আয়াতঃ আন্টি আপনি আগে বলবেন না? তনয়ার মাশরুমে অনেক এলার্জি। আয়াত তাড়াতাড়ি রুমে গিয়ে কিছু ঔষধ এনে তনয়াকে খাইয়ে দিলো।
তার কিছুক্ষন পর তনয়া একটু সুস্থ হলো। আয়াত সালেহা আন্টিকে বললো,-----
আয়াতঃ আন্টি আজ থেকে ঘরে মাশরুম, হাসের ডিম, সিম, বেগুন, আখরোট এসব জিনিস রান্না করবে না বা কিনেও আনবেন না। কারন এগুলোতে তনয়ার এলার্জি আছে। আর হ্যা বাড়িতে বেলি ফুলও কখনো আনবেন না তনয়ার বেলি ফুলেও এলার্জি আছে।
সালেহাঃ ঠিক আছে বাবা।
তনয়া বিস্ময়ের চোখে আয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর বললো
তনয়াঃ আপনি কি করে জানলেন আমার এসবে এলার্জি আছে?
আয়াতঃ তনয়ার প্রশ্ন শুনে থমকে যায়। তারপরও তুতলিয়ে বলে । তো তো তোমার মায়ের কাছ থেকে জেনেছি।
তনয়া আর কোন কথা বললো না। কারন তনয়া জানে ওর মা এগুলো আয়াতকে বলেনি। আর আয়াতের কাছে উত্তর জানতে চেয়েও কোন লাভ নাই। তাই ঠিক করলো ওর মাকে ফোন করে কনফ্রম হবে। খাবার শেষে আয়াত তনয়াকে বললো আমি কিছু কাজে বাইরে যাচ্ছি। তুমি রেস্ট না। আয়াত বাইরে যেতেই তনয়া ওর মাকে ফোন করে জানতে চায় আয়াত তার কাছ থেকে তনয়া এলার্জির বিষেয়ে কিছু জানতে চেয়েছে কিনা? কিন্তু অবাক বিষয় তনয়ার মা আয়াতের সাথে এসব বিষয়ে কোন কথাই বলেনি।
তনয়ার সন্দেহ আস্তে আস্তে সত্যি হতে থাকে। আরো কিছু জানার জন্য তনয়া সালেহা আন্টির কাছে যায়। শুনেছে আন্টি নাকি আয়াতদের বাসায় অনেক বছর ধরে আছে।
তনয়াঃ আন্টি আপনার কাছে কিছু জানতে চাইবো। রাগ করবেন নাতো।
সালেহাঃ মেয়ের কথা শুনো? কি বলবা বলো?
তনয়াঃ আন্টি আয়াত এখানে কত দিন ধরে থাকে?
সালেহাঃ তা প্রায় এক বছর তিন চারমাস হবে।
তনয়াঃ কি? ওহ। আচ্ছা এখানে একাই থাকতো। মানে কোন বন্ধু বান্ধব?
সালেহাঃ আরে নাহ। মাঝে মাঝে আয়াত বাবার এক বন্ধু আসতো নাম রাহাত। সে তার খুব কাছের বন্ধু। আয়াত বাবা এ বাড়িতে কোন বন্ধু আনতো না। বলতো এটা একটা রাজকুমারির জন্য সাঁজাচ্ছি। বন্ধুদের এনে এর সৌন্দয্য নষ্ট করবো না।
তনয়াঃ রাজকুমারী! কে ?
সালেহাঃ জানি না মা। জানো আয়াত বাবা বছর খানেক আগে দুই বার আত্নহত্যা করতে চেয়েছিলো। কিন্তু আল্লাহর অশেষ দয়া। তিনি তার কোন ক্ষতি করেননি।
আত্নহত্যার কথা শুনে তনয়ার বুকটা কেঁপে উঠলো।
তনয়াঃ কেন? কি হয়েছিলো?
সালেহাঃ তেমন কিছু জানি নারে মা? তবে মনে হয় কোন মেয়ের কারনে। বাদ দেও তো ওসব পুরানো কথা?
জানো তুমি খুব ভাগ্যবতী। একটা মেয়ে ঠিক কতটা ভাগ্যবতী হলে আয়াতের মত স্বামী পায় তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। আয়াত বাবা ভিষন ভালো। মেয়েদের খুব সম্মান করে। তবে তার মনের মধ্যে চাপা কোন কষ্ট আছে। যেটা কাউকে বলতে পারছে না। তুমি তার একটু খেয়াল রেখো। এই বলে সালেহা সেখান থেকে চলে গেলো।
তনয়া গভীর ভাবনায় পরে গেলো। কিছু কিছু জিনিস মিলাতে পারছে না। কেমন যেনো সব ধোয়াশা ধোয়াশা লাগছে। আচ্ছা কে সেই মেয়ে? যার কারনে আয়াত সুইসাইড করতে গিয়েছিলো? সে মেয়ের সাথে আমার কি কোন প্রকার সম্পর্ক আছে? নাহ আমিতো এক বছর আগে আয়াতকে চিনতাম না? মাত্র দেড় মাস যাবত আয়াতকে চিনি আমি। তবে আয়াতের ব্যবহার, কথা বলার ধরন আমার এত পরিচিতো লাগে কেন? আর আয়াতই বা আমার সম্পর্কে এত কিছু কিভাবে জানে? আর ও বার বার কিসের প্রতিশোধের কথা বলে? ওর যদি সেই মেয়ের কারনে মেয়েদের ওপর রাগ থাকতো তাহলে ও আমায় এভাবে কষ্ট দিতো না? তাহলে কষ্ট দেবার ধরনটা অন্য রকম হতো? কিন্তু রাগটা শুধু আমার উপর! ঠিক আমার উপর না, আমার মনের উপর? উফ আর ভাবতে পারছি না। মাথাটা খুব ব্যাথা করছে।
কিছুক্ষন পর আয়াত আসলো। দুজন মিলে ঘরের সব কিছু গুছিয়ে রাতের খাবার খেয়ে তনয়া আয়াতকে বললো দেখুন বেড রুম দুটো একটায় আপনি একটায় আমি। খবরদার আমার বেডরুমের চারপাশেও আসবেন না। ঠাঙ ভেগে হাতে ধরিয়ে দিবো। এই বলে তনয়া অন্য রুমে চলে গেলো। আয়াত ওর তাকিয়ে মুচকি হেসে ওর পিছু পিছু গেলো।
তনয়াঃ আপনাকে এখানে আসতে নিষেধ করছি না?
আয়াতঃ আমার বৌ যেখানে আমিতো সেখানেই থাকবো?
তনয়াঃ বাজে কথা বন্ধ করুন চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ুন।
আয়াতঃ ঠিক আছে কিন্তু এ রুমে আমার একটা জিনিস আছে সেটা নিয়েই চলে যাবো।
তনয়াঃ তাড়াতাড়ি নিয়ে বিদায় হন। খুব ঘুম পাচ্ছে আমার।
আয়াত তনয়াকে কোলে তুলে নিলো।
তনয়াঃ কি করছেন কি?
আয়াতঃ আমার জিনিস আমি নিয়ে যাচ্ছি।
তনয়াঃ ছাড়ুন বলছি। ছাড়ুন।
আয়াতঃ বেশি কথা বললে এত দিন যেটা করিনি সেটা জোড় করে আদায় করে নিবো !
তনয়াঃ মমমম মানে?
আয়াতঃ চুপচাপ আমার বুকে ঘুমিয়ে থাকবে। তাহলে তোমাকে কিছু করবো না প্রমিস। আর ওঠার চেষ্টা করলে উল্টা পাল্টা কিছু করে দিবো। তখন আবার বলো না আমি তোমার সাথে জোড় করেছি?
তনয়া আর কথা বললো না। আয়াতের বুকে চুপচাপ শুয়ে শুয়ে ভাবছে। লোকটা এরকম কেন? আমার এত যত্ন করেন অথচো আমাকে সব থেকে বেশি কষ্টটাও ওনিই দেন। ওনাকে ভয় করে । কিন্তু ওনার বুকেই আমি সব থেকে বেশি শান্তি খুজে পাই। মাথাটা উঠিয়ে দেখে আয়াত ঘুমিয়ে পড়েছে। অপলক দৃষ্টিতে আয়াতের দিকে কতক্ষন তাকিয়ে থাকে। তারপর আলতো আয়াতের ঠোটে নিজের ঠোটটা ছুয়ে চুপচাপ আয়াতের বুকে ঘুমিয়ে পড়ে। হয়তো আয়াত টের পেয়েছে। হয়তো না।
সকালে ওঠে আয়াত অফিসে চলে যায়। তনয়া টুকিটাকি কাজ সেড়ে নেয়।তারপর ফোনের ব্ল্যাক লিস্টে থাকা নীলের নাম্বারটাকে আনব্লক করে নীলকে ফোন দেয়।
তনয়াঃ হ্যালো নীল।
নীলঃ হাই সুইট হার্ট। ম্যারেড লাইফ কেমন কাটছে?
তনয়াঃ জাস্ট সেটাপ। আমার তোমার কাছে থেকে কিছু কথা জানার ছিলো?
নীলঃ ও রিয়েলি? বলেন ম্যাডাম?
তনয়াঃ তুমি ঠিক কত দিন সিলেট থেকেছো?
নীলঃ কেন? ছয় না না একবছর।
তনয়াঃ এমনিতেই।
তনয়াঃ তুমি আমার হ্যাজবেন্ড মানে আয়াতকে চেনো?
নীলঃ সোনা তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই ?
তনয়াঃ প্লিজ নীল। আমার জানাটা খুব প্রয়োজন।
নীলঃ স্যরি ডিয়ার তোমার অনুরোধ রাখতে পারবো না। তবে হ্যা কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়।
তনয়াঃ জাস্ট সেটাপ। তনয়া রাগ করে ফোন কেটে দিলো।
ভিষন রাগ হচ্ছে নীলের উপর তার থেকেও বেশি নিজের উপর। কারন ও নীলের মত একটা লম্পটকে ভালোবেসেছিলো। সেদিন তনয়া আয়াতের রুমটা ভালো করে চেক করলো কিন্তু কিছুই পেলো না। কিন্তু আয়াতের আলমিরাটা লক ছিলো নেটা দেখতে পারেনি। কারন চাবি আয়ারতর কাছে।
আজ আয়াতের দুটো বন্ধু আয়াতের বাসায় আসবে তনয়াকে দেখতে। তরা বিয়েতে যেতে পারেনি। তাই এখানে আসবে। দুপুরে খাবে।
দুজন লোক আসলো তার মধ্যে একজনকে দেখে তনয়া হতবাগ হয়ে গেলো।
আয়াতঃ তনয়া এরা আমার খুব কাছের বন্ধু আসিফ আর রাহাত।
রাহাত আর কেউ নয় নীল। তনয়া ভাবছে তারমানে নীলের আসল নাম রাহাত? আর আয়াত আর নীল একে অপরকে চেনে? তনয়ার মাথা যেনো কাজ করা বন্ধ করে দিছে। দপ করে মাটিতে পড়ে গেলো।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন