আমার সামান্য দূরেই একটা সাদা মোমবাতি জ্বলছে। সামান্য বাতাসের জাপটা এসে মোমের শিখা টা একটু দুলিয়ে দিয়ে গেল। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বছরের এই সময়টায় সাধারণত বৃষ্টি হয় না। আজ হচ্ছে।ঝুম বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টি পরার শব্দ হচ্ছে। এ শব্দগুচ্ছ যেন আমার সমস্ত আনুভূতি ইন্দ্রিয় কে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমার সামনে রাখা মোমবাতিটা ক্রমেই ফুরিয়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবনটা ও যেন মোমের মত। জ্বলেই ফুঁড়িয়ে যায়। থেকে যায় কিছু সৃতি, স্বপ্ন, ভালোবাসা, আর ভালোবাসার মানুষ গুলো।
মোমটা ফুঁড়িয়ে গেল। ঘরটা আঁধারে ঢাকে গেল। হাতের কাছেই সদ্য কেনা মোবাইল নামক বার্তা যন্ত্রটি আছে। চাইলেই আলো জ্বালানো যায়। কিন্তু জ্বালাতে ইচ্ছা করছেনা। কখনো কখনো অন্ধকার ভালো লাগে। অন্ধকার আছে বলেই মানুষ আলোর প্রয়োজনীয়তাটা আনুভব করে। আজ না হয় অন্ধকারেই থাকি।
পাশের পুকুরপাড় থেকে ব্যাঙ ডাকার শব্দ আসছে। বিদ্যুৎ চমাকচ্ছে। একটা কুকুর দরজার সামনে আশ্রয় নিয়েছে। অন্ধকারে সব অদ্ভত সুন্দর লাগছে।
পকুরপাড়ের পাশে একটি কাঁচা রাস্তা। রাস্তা দিয়ে সামান্য একটু এগুলেই রেল লাইন । রেল লাইন ধরে বাঁ দিকে কিছুটা এগুলেই একটা পুল। পুল পার হলেই দেখা যায় একসারি সেগুণ গাছ মাথা উঁচু করে দারিয়ে আছে। তার পেছনর দিকটায় একটি বাড়ি। রূপাদের বাড়ি।
রূপাকে প্রথম কবে দেখেছিলাম? মনে করতে পারছিনা। স্মৃতি গুলো জাপসা হয়ে আসছে।
আজ থেকে সম্ভবত তিন বছর আগে, ফুঁপির হলুদ অনুষ্ঠান চলছে। আমি তথন মাত্র সিগারেট খাওয়া শিখেছি। সিগারেট খাওয়ার জন্য আসর থেকে বের হয়ে পুকুর পাড়ে আসেছি। প্যাকেট থেকে সদ্য উন্মুক্ত হওয়া বেনসন এন্ড হেডস টা মাত্র জ্বালিয়েছি আর বৃষ্টি শুরু হলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই ভিজে চুপসে গেলাম। কি করব বুঝতে না পেরে ভেজা বেনসনটা হাতে নিয়ে বসে রইলাম।
একটু দূরে একটা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে। কেউ একজন হাতে হারিকেন নিয়ে এদিকেই আসছে। নূপুরের রিন রিন শব্দও পাচ্ছি। আরেকটু কাছে আসায় অবয়ব টা স্পষ্ট হল। একটা মেয়ে। মেয়েটি আরো কাছে আসলো। হ্যারিকেনের মৃদু আলোতে তাকে দেখলাম। হলুদ একটা শাড়ি পরেছে সে। হাতের কাঁচের চুড়ি গুলো ক্রমাগত বেজেই চলছে। টানাটানা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঠোঁটের উপর সামান্য বৃষ্টির ছটা পরেছে। মাথায় একটা কালো ছাতা ধরে রেখেছে। মনে হচ্ছে রূপকথার কোনো গল্প থেকে উঠে আসা হলুদ একটা পরী। ও পরী একটা মানুষ এত সুন্দর হয় কি করে?
আমি তাকিয়ে আছি অপলক দৃষ্টি তে।
আমার অনেকটা কাছে আসে অভিমানের সুরে বলল, এই যে এখানে একা বসে ভিজছেন কেন?
ঃ আ আ আম আমি আসলে
কিছুই বলতে পারলাম না। গলা শুকিয়ে গেছে। জল দরকার অনেখানি।
বুজেছি। ভেজার ভুত চেপেছে? আসুন আমার সাথে। উঠুন। বলেই আমার হাত ধরল।
তার হাতের উষ্ণতা আনুভব করলাম। মনে হল এর চেয়ে সুন্দর অনুভূতি কি থাকা সম্ভভ? হয়ত না।
আমি হলুদ পরীকে অনুসরন করছি। সে আমাকে উঠোন পর্যন্ত নিয়ে আসলো। বলল যান এবার ঘরে গিয়ে শুকনো কাপড় পরে নিন। নাহয় ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
সে চলে যাচ্ছে আমাকে একা করে। আমি নিঃচুপ দাড়িয়ে আছি। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে তাকে বলার জন্য, তুমি আমাকে একা ফেলে যেওনা পরী।তোমাক ছাড়া যে আমি অসহায়। কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারলাম না। কথা গুলো বুকেই জমা রইল। কণ্ঠনালী দিয়ে উন্মুক্ত হল না।
আজও সে এসেছিল। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে অনেকটা সময় জুড়ে। একফোঁটা জল ও গড়িয়ে পরেছিল তার গাল বেয়ে।
আজও আমি কিছুই বলতে পারিনি। আমি বলতে পারিনি তোমার গাল বেয়ে পরা জলকণার মূল্য যে আমার প্রান পাখিটার সমান।
আজও রুপা হলুদ্ শাড়ি পরেছে। আজও বৃষ্টি হচ্ছে। ঠিক সেদিনের মত।
আমার দৃষ্টি যাপসা হয়ে যাচ্ছে। আনুভূতি গুলো মলিন হয়ে আসছে। বলতে ইচ্ছা করছে বিদায় রুপা। তুমি ভালো থেকো।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন