হিজড়াদের জন্য মাদরাসা : এ ব্যাপারে পর্দার হুকুম কী?
মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী| সম্পাদক, মাসিক আদর্শ নারী: সম্প্রতি একটি সামাজিক দাতব্য ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে কিছু সমাজ সেবক আলেমের উদ্যোগে হিজড়াদের পবিত্র কুরআন ও ইলমে দ্বীন শিক্ষা দেয়ার এক ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে হিজড়াদের দ্বীন শিক্ষার জন্য “তৃতীয় লিঙ্কের মাদরাসা” নামে একটি স্বতন্ত্র মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটা খুবই প্রশংসনীয় ও মহৎ কাজ।
তবে এক্ষেত্রে তাদেরকে মহিলা মাদরাসার মতো পর্দার অন্তরালে রেখে পড়াতে হবে নাকি পুরুষদের মাদরাসার মতো ওপেনভাবে পড়ানো যাবে এবং তাদেরকে মহিলা শিক্ষিকার মাধ্যমে পড়াতে হবে নাকি পুরুষ শিক্ষকের মাধ্যমে পড়ানো যাবে–এ সম্পর্কে শরীয়তের হুকুম কী–তা জানা ও মানা দরকার।
এ সম্পর্কে শরীয়তের মাসআলা হলো–হিজড়াদের মধ্যে দু’টি শ্রেণী হতে পারে : নারীদের মতো আকৃতির হিজড়া এবং পুরুষদের মতো আকৃতির হিজড়া। হিজড়াদের মধ্যে যাদের বাহ্যিক আকার-আকৃতি এবং শারীরিক গঠন ও প্রস্রাব-অঙ্গ নারীদের মতো হবে, তাদেরকে নারী গণ্য করে তাদের জন্য নারীদের বিধি-বিধান প্রয়োগ করতে হবে। সে মতে অন্যান্য পুরুষদের জন্য তাদের সাথে পর্দা করতে হবে এবং বেপর্দাভাবে বা সরাসরি তাদেরকে কোন পুরুষ উস্তায পড়াতে পারবেন না বা তা জায়িয হবে না। আর এ ধরনের হিজড়ারা সাধারণ নারীদের মতো পর্দাবৃত হয়ে বা বোরকা-হিজাব পরে চলাচল করবেন। এভাবে শরীয়তের অন্যান্য আহকামও তাদের উপর নারী রূপেই প্রযোজ্য হবে।
(দ্রষ্টব্য : সুনানে বাইহাকী কুবরা, হাদীস নং ১২৯৪, কানযুল উম্মাল, হাদীস নং ৩০৪০৩/ আল-রাহরুর রায়িক, ৯ম খণ্ড, ৩৩৬ পৃষ্ঠা/ রদ্দুল মুহতার, ১০ম খণ্ড, ৪৪৯ পৃষ্ঠা)
সুতরাং এ ধরনের হিজড়াদের জন্য মাদরাসা করলে সেই মাদরাসাটি প্রচলিত মহিলা মাদরাসার ন্যায় পর্দাসমৃদ্ধ-রূপে করতে হবে। এমতাবস্থায় তাদের দ্বীনী শিক্ষার জন্য শুধু “তৃতীয় লিঙ্গের মাদরাসা” করা যথার্থ হবে না, বরং সেসব মহিলা হিজড়াদের জন্য মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
পক্ষান্তরে যেসব হিজড়াদের আকার-আকৃতি ও শারীরিক গঠন প্রকৃতির দিক থেকে পুরুষের সাথে বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বাহ্যিক অবয়ব ও প্রস্রাবের অঙ্গ পুরুষের মতোই, তাদেরকে পুরুষ হিসেবে গণ্য করতে হবে। এ ধরনের হিজড়ারা মহিলাদের নিকট বেপর্দাভাবে যেতে পারবে না এবং সকল মহিলাদের জন্য এসব হিজড়াদের থেকে পর্দা করতে হবে। এভাবে শরীয়তের অন্যান্য আহকামও তাদের উপর পুরুষরূপেই অর্পিত হবে।
(দ্রষ্টব্য : সুনানে বাইহাকী কুবরা, হাদীস নং ১২৯৪, কানযুল উম্মাল, হাদীস নং ৩০৪০৩/ আল-রাহরুর রায়িক, ৯ম খণ্ড, ৩৩৮ পৃষ্ঠা/ রদ্দুল মুহতার, ১০ম খণ্ড, ৪৪৯ পৃষ্ঠা)
এ ধরনের পুরুষ হিজড়াদের জন্য পুরুষদের মাদরাসার মতো ওপেনভাবে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে তাদেরকে পুরুষ উস্তায পড়াতে পারবেন। এ হিসেবে এ সকল পুরুষ হিজড়াদের জন্য যে মাদরাসা করা হবে, তা “পুরুষ হিজড়াদের জন্য মাদরাসা” নামে হতে পারে।
সুতরাং এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় হলো–নারী হিজড়া ও পুরুষ হিজড়া সবাইকে একসাথে করে সরাসরি কোন পুরুষ বা মহিলা উস্তায দ্বারা ইলমে দ্বীন শিক্ষার দেয়ার কোন অবকাশ নেই। অন্যথায় তাতে ইসলামের পর্দা বিধান লংঘন হয়ে যাবে। অথচ ইসলামের বিধান লংঘন করে ইসলাম শিক্ষা দেয়ায় কোন মাহাত্ম্য থাকে না। বরং এটা নাজায়িয পদ্ধতিতে পুরুষ ও মহিলাদেরকে বেপর্দাভাবে একসাথে করে সহশিক্ষা প্রদানেরই নামান্তর হবে। যা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়।
তাই হিজড়া বলতেই একভাবে দেখা যাবে না, তারা কেউ নারী এবং কেউ পুরুষ। আর যার ব্যাপারে কোনদিক চূড়ান্ত হবে না, তাকে “খুনসায়ে মুশকিল (দুর্বোধ্য হিজড়া)” বলে। তাদেরকে পুরুষ বা মহিলা উভয়শ্রেণীর সম্ভাবনাময় গণ্য করে তাদের সাথে সাধারণ পুরুষ ও মহিলা উভয়কেই সতর্কতা অবলম্বন করে চলতে হবে।
বলা বাহুল্য, ইসলামের দৃষ্টিতে তৃতীয় লিঙ্গ বলতে পুরুষ ও মহিলার বাইরে আলাদা কোন লিঙ্গ নেই। বরং ইসলামের হুকুম মতে তাদেরকে আকৃতি ও গঠন অনুযায়ী পুরুষ ও নারী শ্রেণীতে বিভক্ত করে সেই হিসেবে তাদের জন্য শরীয়তের হুকুম ফলো করতে হবে। এ হিসেবে হিজড়াদেরকে তৃতীয় লিঙ্গ বলা বা তাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাকে “তৃতীয় লিঙ্গের মাদরাসা” বলা সঙ্গত হয় না। বরং পুরুষ হিজড়াদের জন্য প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাকে “পুরুষ হিজড়াদের মাদরাসা” এবং মহিলা হিজড়াদের জন্য প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাকে “মহিলা হিজড়াদের মাদরাসা” বলাই যুক্তিযুক্ত।
এক্ষেত্রে অবশ্যই নারী হিজড়াদের সাথে পুরুষ হিজড়া ও সাধারণ পুরুষগণ পর্দা রক্ষা করবেন এবং পুরুষ হিজরাদের সাথে নারী হিজড়া ও সাধারণ নারীগণ পর্দা করে চলবেন। আর এভাবে শরয়ী হুকুম মেনেই পুরুষ-হিজড়াদের জন্য পুরুষ মাদরাসা ও নারী-হিজড়াদের জন্য মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সেই সাথে হিজড়াদের পুনর্বাসনের জন্য তাদেরকে তাদের পরিবার ও সমাজের সাথে যুক্ত করে জীবন যাপনের স্বাভাবিক ধারায় নিয়ে আসাও প্রয়োজন। এর জন্য চাই সুচিন্তিত ও দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা। এর সাথে দরকার উপযুক্ত দাওয়াতী মেহনত। এ ব্যাপারে সবার এগিয়ে আসা দরকার। সর্বপরি এ ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন