বাঙালির ঘরে ঘরে সুপারির ব্যবহার অপরিহার্য। সে পুজো আচ্চা বলুন বা কোনও শুভ অনুষ্ঠান, সুপারি ছাড়া কোনটাই সুসম্পন্ন হয় না। বিশেষ করে লক্ষ্মী পুজোয় সুপারি লাগে, কারণ এটি মা লক্ষ্মীর অন্যতম প্রিয় জিনিস। অনেকের আবার সুপারি খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে। খাওয়ার পর বা অবসর সময়ে টুকরো করে রাখা সুপারি চিবিয়ে খেতে ভালোবাসেন। দাদু-ঠাকুমার যুগে সুপারি কাটার জন্য স্পেশাল একটি যন্ত্র অনেকের বাড়িতেই মজুত থাকতো। যা যাতি নামে পরিচিত। তখনকার যুগের মতো পান ও মশলার ডালি, যাতি নিয়ে সুপারি কাটা এবং পান সাজাতে বসার রেওয়াজ এখন অনেকটায় কমে গেছে। তবে আপনি হয়তো জানলে অবাক হবেন, সামান্য সুপারির কিন্তু অনেক গুণ। নিয়মিত সুপারি খেলে অ্যানিমিয়া, পাচনতন্ত্র, কোষ্ঠকাঠিন্য, দাঁতের নানা সমস্যা সহ একাধিক শারীরিক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। আমাদের এই প্রতিবেদনে সুপারি খাওয়ার উপকারিতা এবং এর কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে সেগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
সুপারি কী ?
সুপারি এরিকাসিয়া (Arecaceae) পরিবারের এরিকা গণের একটি ফল। এর বৈজ্ঞানিক নাম আরিকা কাটেক্যু (Areca Catechu)। ইংরেজিতে বিটল নাট নামে পরিচিত। একটি সুপারি গাছ নারকেল গাছের মতো লম্বা হয়। সুপারি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। এছাড়াও ভারক, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, পাকিস্তান, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, চিন প্রভৃতি দেশে সুপারি চাষ করা হয়। সুপারি গরম এবং অ্যাসাডিক প্রকৃতির, তাই সীমিত পরিমাণে এটি গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
সুপারি খাওয়ার উপকারিতা
১. স্ট্রোক : সুপারি খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে বলার সঙ্গে সঙ্গে এর ব্যবহার স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফ্ল্যাভোনয়েড, অ্যালকালয়েডস, টের্পেনয়েডস, ট্যানিনস, সায়ানোজেনিক, গ্লুকোসাইড, আইসোপ্রেনয়েড, অ্যামিনো অ্যাসিড এবং ইউজেনল জাতীয় বিশেষ উপাদানগুলি লাল সুপারির পাতায় পাওয়া যায়। এই সমস্ত উপাদানগুলি স্ট্রোক (মানসিক এবং কার্ডিওভাসকুলার) ঝুঁকি কমাতে উপকারী হতে পারে (১)। এই কারণে অনেকের বিশ্বাস, যে লাল সুপারি পাতার সঙ্গে সুপারি ব্যবহার স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। তবে এ বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন।২. সিজোফ্রেনিয়া : সিজোফ্রেনিয়া (একটি মানসিক ব্যাধি) রোগের ক্ষেত্রেও সুপারি উপকারী প্রমাণিত হতে পারে। আসলে সুপারির মধ্যে বিভিন্ন ধরণের কার্যকরী ফ্ল্যাভোনয়েড রয়েছে, যার মধ্যে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি প্রভাব উপস্থিত। এই কারণে সুপারি অনেক মানসিক এবং স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা যেমন, অ্যালজাইমার, পার্কিনসনস, অ্যামিওট্রোফিক ল্যাট্রাল স্ক্লোরোসিস, হান্টিংটন এবং সিজোফ্রেনিয়া থেকে মুক্তি পেতে কার্যকরী হতে পারে (২)।
৩. দাঁতের ক্যাভিটি থেকে মুক্তি : যদিও অতিরিক্ত সুপারি খাওয়ার কারণে দাঁত এবং মাড়ির ক্ষয় লক্ষ্য করতে পারেন, কিন্তু সীমিত মাত্রায় এর ব্যবহার দাঁতের নানা সমস্যা দূর করতে পারে। যেমন সবচেয়ে সাধারণ সমস্যা ক্যাভিটি দূর করতে এটি দারুণ কার্যকরী। বিশেষজ্ঞদের মতে এতে অ্যান্থেলিমিন্টিক এফেক্টস (পরজীবী ধ্বংসকারী) রয়েছে, যা ক্যাভিটির সমস্যা দূর করতে উপকারী হতে পারে (৩)। তবে এবিষয়ে আরও গবেষণা দরকার।
৫. ঠোঁটের ফোসকা : ঠোঁটে অনেক সময় ফোসকা মতো হয়ে যায়, চামড়া উঠে যায়। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে লাল সুপারি ব্যবহার করতে পারেন। বলা হয়, লাল সুপারি এমন একটি উদ্ভিদ যার মধ্যে নানা গুরুত্বর সমস্যা সমাধানের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যা ঠোঁটে ফোসকা (মুখে আলসারের লক্ষণ) নিরাময়েও সাহায্য করতে পারে। তবে এই বিষয়ে দৃঢ় প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
৮. হজমে সহায়ক : সুপারি নিয়ে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সুপারি খাওয়ার ফলে মুখে লালা প্রক্রিয়াকে বাড়িয়ে তোলে যা হজম প্রক্রিয়ায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। একইসঙ্গে এটি হজমের রস বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে যা পরিপাক প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করে তোলে। এছাড়াও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে উপকারী হতে পারে। এই কারণে বলা যেতে পারে, যে খাওয়ার পর সুপারি খেলে হজমের জন্য উপকারী হতে পারে (৭)।
১০. কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে : নিবন্ধে ইতিমধ্যে উল্লিখিত যে, সুপারি খাওয়াকে লালা রস এবং হজম রস বাড়াতে সহায়ক বলে মনে করা হয়। হজমের সমস্যা থাকলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভোগেন অনেকে। এই সমস্যা থেকে সঠিক মাত্রায় সুপারির ব্যবহার করে উপকারি পেতে পারেন (৭)।
১২. ডায়রিয়া থেকে মুক্তি : সুপারি সম্পর্কিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সুপারি গ্রহণের ফলে ডায়রিয়ার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। আসলে এতে প্রচুর পরিমাণে পলিফেনল পাওয়া যায়, এতে ইমিউনোমডুলেটরি এবং অ্যান্টি-অ্যালার্জিক প্রভাব পাওয়া যায়। এই প্রভাবগুলি ডায়রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক ঝুঁকি কমাতে পারে। এর থেকে মনে করা হয় যে সুপারি খাওয়া ডায়রিয়ার সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে (৯)।
১৪. মাড়িতে ইনফেকশন : সুপারি মাড়ির জন্য অ্যাস্ট্রিনজেন্ট (অ্যাসিডিক এবং স্নায়ু শক্তিশালীকরণ প্রভাব) হিসেবে কাজ করে, যা মাড়ি থেকে রক্তপাতের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে বলে মনে করা হয়। এছাড়াও মাড়িকে স্বাস্থ্যকর ও শক্তিশালী রাখতে উপকারী। মাড়ির সংক্রমণের সমস্যা দূর করতেও সহায়ক হতে পারে (১১)।
১৫. প্রস্রাবে সমস্যা : প্রস্রাবের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে সুপারির ব্যবহার সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণটি হল এতে সাফ্রোল নামক একটি উপাদান রয়েছে যা মূত্রাশয়ের প্রক্রিয়াকে উন্নত করে এবং সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে (১২)।
সুপারি পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ। বিশেষ করে আরকোলিন, আরকাইন, আরকেডাইন, কোলাইন, গুয়াসাইন, গুভাকোলিন, গ্যালিক ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ট্যানিন।
সুপারি কীভাবে ব্যবহার করবেন
নিম্নলিখিত ভাবে সুপারির ব্যবহার করতে পারেন (১১) –
সুপারির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
সুপারির যেমন উপকারিতা রয়েছে, পাশাপাশি এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়, অতিরিক্ত মাত্রায় সুপারি গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। তাই সীমিত মাত্রায় সুপারি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। অন্যদিকে আপনি যদি কাঁচা সুপারি খান, সেক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে (১১)।
সুপারি খেলে কী উপকার পাবেন সেটা নিশ্চয় এবার জেনে নিলেন। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলিও মাথায় রাখবেন। পাশাপাশি অতিরিক্ত মাত্রায় এর ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। মনে রাখবেন অতিরিক্ত সুপারির ব্যবহার শারীরিক সমস্যার কারণ হতে পারে। যদি সুপারি খাওয়ার কারণে কোনও শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় সেমতো পদক্ষেপ নিন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন