যে কোনো স্বাস্থ্যসচেতন মানুষই ফ্যাটের নামে ভুরু কোঁচকান এবং তার ফল স্বরূপ লো-কার্ব ডায়েটের দিকে ঝোঁকেন। এক্ষেত্রে মানুষ সবচেয়ে বেশি যার ওপর ভরসা করেন, তা হল ফল। কিন্তু অনেকেই জানেন না যে, বেশিরভাগ ফলেই উচ্চমাত্রায় কার্বোহাইড্রেট থাকে। আর কিছু ফলে থাকে হেলদি ফ্যাট। এরকমই একটি ফল হল অ্যাভোকাডো। আপনাদের জানিয়ে রাখি, অ্যাভোকাডোতে স্বাস্থ্যকর অর্থাৎ হেলদি ফ্যাটের পরিমাণই বেশি। তাই, বর্তমানে স্বাস্থ্যসচেতন মানুষদের মধ্যে অ্যাভোকাডো খাবার প্রবণতা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। এই ফলে রয়েছে আরও নানারকম স্বাস্থ্যগুণ, যার অনেকটাই সবার জানা। তবে আরও অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেছে অনেকের মধ্যে।
অ্যাভোকাডো ফলের পরিচিতি
অ্যাভোকাডোর বিজ্ঞানসম্মত নাম হল পার্শ্বিয়া আমেরিকানা (Persea americana)। আনুমানিক ৭০০০ বছর আগে থেকে দক্ষিণ মেক্সিকো এবং কলোম্বিয়াতে অ্যাভোকাডোর চাষ হয়ে আসছে। ফলটির খোসা কুমিরের গায়ের মতো অমসৃণ এবং গড়ন ন্যাশপাতির মতো। তাই সেসময় অনেক জায়গায় এটি ‘alligator pears’ বা কুমির ন্যাশপাতি নামে পরিচিত ছিল।
আমেরিকান জার্নাল অফ ক্লিনিকাল নিউট্রিশনের তথ্য অনুসারে, অ্যাভোকাডো হল সেই খাবারের মধ্যে অন্যতম যাদের জিআই ভ্যালু নির্ধারিত জিআই বা গ্লাইসেমিক ইনডেক্স মানের মধ্যেই থাকে। এটিতে খুব কম পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট রয়েছে। তাই, কেউ যদি একাধিক অ্যাভোকাডোও খান, তাতে মাত্র ২৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট-ই তাঁর শরীরে প্রবেশ করবে যা একদমই ক্ষতিকারক নয় (১)।
মাখনের মতো মসৃণ, কোমল এবং খাদ্যগুণে ভরপুর এক চমৎকার সুগন্ধী ফল হল অ্যাভোকাডো। যার উপকারিতা গুনে শেষ করা যায় না।
গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাভোকাডো খেলে সিরামে HDL বা ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পায় যা হৃৎপিন্ডের স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ উপকারী। (২) যদিও এই তথ্য বৈধকরণের জন্য আরও গবেষণা চলছে।
আবার অন্য এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়ছে যে, নিয়মিত অ্যাভোকাডো খেলে LDL বা খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস পায় ফলে হৃদরোগের সম্ভাবনা কমে।(৩) এতে থাকা মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট ও হৃৎপিন্ড সুরক্ষিত রাখে এবং এর কার্যকারিতা বজায় রাখে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা রোজ অ্যাভোকাডো খান, তাঁদের বিএমআই (BMI) রেট কম হওয়ায় অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধির সমস্যা দেখা যায় না। (৭) এতে থাকা ফাইবার ও মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড যে কোনও রকমের মেটাবলিক সিন্ড্রোমের ঝুঁকি কমায়।
প্রতিদিন অ্যাভোকাডো খেলে তা ক্যারিটনয়েডের শোষণ বাড়িয়ে তোলে। লুটেনিন (Lutein) এবং জেক্সানথিন (zeaxanthin) এবং অন্যান্য ক্যারোটিনয়েডগুলি দৃষ্টিশক্তি বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয়। এই যৌগগুলি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হওয়া ম্যাকুলার ডিজেনারেশন, ছানি এবং অন্যান্য চোখের রোগ প্রতিরোধ করতে পারে।
আমরা যখন দেখি, সেসময় নীল আলো ফিল্টারের কাজ করে ম্যাকুলার পিগমেন্টেশন। আর অ্যাভোকাডো ম্যাকুলার পিগমেন্টেশনের ঘনত্বও বৃদ্ধি করে।(৮) ভিটামিন-ই সমৃদ্ধ এই ফলে রয়েছে আরও অত্যাবশ্যকীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান যা চোখের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
এছাড়াও এতে থাকা ফাইটোকেমিক্যাল সহ মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটের মতো উপাদানগুলি শরীরে ক্যান্সার কোষ উৎপাদন হতে না দিয়ে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমায়। সর্বোপরি, ফাইটোকেমিক্যাল ক্যান্সার কোষের উৎপাদন বাড়তে দেয় না আবার ক্যান্সার সেল লাইনে ক্যান্সারাস কোষগুলির মৃত্যু ঘটিয়ে রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।(১০) তাই, একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ফাইটোকেমিক্যাল উপাদানটিকে খাদ্যনালী এবং কোলন ক্যান্সারের উপযুক্ত পরিপূরক চিকিৎসা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
অ্যাভোকাডোতে থাকা পটাশিয়াম দাঁতের অবক্ষয় রোধ করে। মাড়িতে প্রদাহ বা ফোলাভাবের মতো সমস্যা দূর করতে পারে এই ফলটি। সর্বোপরি, ওরাল ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
কাঁচা অ্যাভোকাডোতে বোরন-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান থাকে যা ক্যালশিয়াম শোষণকে বাড়িয়ে তুলে হাড় মজবুত করে। এতে থাকা ভিটামিন-কে ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানগুলি মজবুত হাড় গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং অস্টিওপ্রোটেক্টিভ প্রভাব ফেলে।
অ্যাভোকাডোতে থাকা ফাইবার ও বিভিন্ন রকম হেলদি ফ্যাট লিভারের কার্যকারীতা বৃদ্ধি করে, খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করে।
কিডনির কার্যকারিতা বজায় রাখতে অ্যাভোকাডো আদৌ কোনওভাবে সাহায্য করে কিনা সেই বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও বিজ্ঞানসম্মত তথ্য পাওয়া যায়নি।
অ্যাভোকাডোতে বেশি মাত্রায় ক্যালোরি থাকলেও, কার্বোহাইড্রেটের মাত্রা অনেকটাই কম থাকে। এছাড়াও, এতে থাকা ফাইবার, অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাট ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানগুলি এটিকে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য উপযুক্ত খাবার করে তুলেছে। আমেরিকান ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন ডায়াবেটিক রোগীদের রোজকার খাদ্যতালিকায় অ্যাভোকাডো রাখার পরামর্শ দেয়। কারণ এতে থাকা ফাইবার ডায়াবেটিক রোগীদের ফাস্টিং ব্লাড সুগার লেভেল কমায়। (১২)
তবে, প্রতিদিন অ্যাভোকাডো খাওয়া শুরু করার আগে আপনি অবশ্যই নিজের চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। কারণ, এই ফলে ক্যালোরির মাত্রা বেশি থাকায় এটি আপনার ওপরে নেতিবাচক প্রভাবও ফেলতে পারে।
অ্যাভোকাডো আমাদের শরীরের পাশাপাশি ব্রেন তথা মস্তিষ্কেরও পুষ্টি জোগায়। এতে থাকা ভিটামিন-ই এবং মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট আমাদের কগনিটিভ ফাংশন উন্নত করে। এমনকি, বয়স্কদের মধ্যে স্মৃতিশক্তি বা মানসিক স্থিতি কমার যে প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তারও প্রতিকার করে। এমনকি, ভিটামিন-ই ও অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান অ্যালজাইমার (Alzheimer) রোগের চিকিৎসায়ও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
ত্বকের প্রদাহজনিত একটি রোগ হল এই সোরিয়াসিস। যা বংশগত হলেও অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত দূষণ এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কারণে বৃদ্ধি পায়। অ্যাভোকাডো তেল বা অ্যাভোকাডো তেলযুক্ত ভিটামিন B12 ক্রিম সোরিয়াসিস রোগের চিকিৎসায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এর মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট উপাদানটি প্রদাহ জনিত উপসর্গের উপশম করতে পারে।
অ্যাভোকাডো ত্বকের তারুণ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এতে থাকা অপরিহার্য ফ্যাটি অ্যাসিড (EFA) টিস্যু লিপিডের সংশ্লেষণে সাহায্য করে। ফলে, ত্বকে বলিরেখা বা বয়সের ছাপ সহজে পড়ে না এবং ত্বক থাকে টানটান। বলিরেখা দূর করার পাশাপাশি অ্যাভোকাডো তেলের ক্ষত নিরাময়ের ক্ষমতাও আছে।
অ্যাভোকাডোতে থাকা ভিটামিন-ই চুলের গোড়া মজবুত করে এবং স্ক্যাল্পের ক্ষত নিরাময় করে চুলের বাড়তে সাহায্য করে। অ্যাভোকাডো তেলের পাশাপাশি অ্যাভোকাডো মাস্কও ব্যবহার করতে পারেন। নীচে আমরা সেই পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করলাম।
এবার বুঝলেন তো, এই ছোট্ট একটি ফল আপনার কী কী জটিল রোগের প্রতিকার এবং সর্বোপরি প্রতিরোধ পারে। মুখোরোচক স্বাদ বা গন্ধের পাশাপাশি অ্যাভোকাডোতে রয়েছে ফাইবার, মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ভিটামিন-ই এবং ভিটামিন-কে -এর মতো প্রচুর পুষ্টি উপাদান।
অ্যাভোকাডোর পুষ্টিগুণ
Daily Value বা %DV = দৈনিক প্রয়োজনের শতাংশ
৬৮ গ্রাম বা অর্ধেক অ্যাভোকাডোতে প্রায় ১১৩ ক্যালোরি, ১৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন-K (দৈনিক প্রয়োজনের ১৯ শতাংশ), ১২ মিলিগ্রাম ভিটামিন-C (দৈনিক প্রয়োজনের ১২ শতাংশ), ০.০৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন-B6 (দৈনিক প্রয়োজনের ৯ শতাংশ), ৬০ মিলিগ্রাম ফোলেট (দৈনিক প্রয়োজনের ১৫ শতাংশ), এবং ৩৪২ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম (দৈনিক প্রয়োজনের ১০ শতাংশ) থাকে।
অতএব দেখা যাচ্ছে, অ্যাভোকাডোর পুষ্টিগুণ অগুণতি প্রায়, তাই না? তবে, আজ থেকে রোজকার ডায়েটে এই ফলের নাম অন্তর্ভুক্ত করছেন তো? কিন্তু কীভাবে?
অ্যাভোকাডোর ব্যবহার
অ্যাভোকাডোর ব্যবহার বহুমুখী। যদিও আমরা টোস্টে, স্যালাডে বা স্মুদিতে ছড়িয়ে খেতে পছন্দ করি ফলটি। তবে, এটি প্রায় সব খাবারের সঙ্গেই যায়। ফলটিকে নুন ও গোলমরিচের সঙ্গে খান অথবা সুপ বা ডেজার্টের মতো বিভিন্ন খাবারের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে বাড়িয়ে নিতেই পারেন প্রতিটি খাবারের খাদ্যগুণ। যেমন –
পদগুলি জিভে জল আনা মনমুগ্ধকর, তাই না? তবে, এই ফলের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। যা জেনে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
অ্যাভোকাডোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
অ্যাভোকাডো খাওয়া ভীষণ উপকারী। কিন্তু তার আগে জেনে নিন, কার কার এই ফলটি খাওয়া উচিৎ নয়। কিংবা অতিরিক্ত মাত্রায় খেলে কী কী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে আপনার ওপর।
অ্যাভোকাডোতে ফ্যাট বেশি থাকে। তাই, ফলটি অতিরিক্ত মাত্রায় খেলে আপনার ওজন বাড়তে পারে।
ল্যাটেক্স অ্যালার্জি আছে যাদের, তাঁরা অ্যাভোকাডো খাবেন না। উপকারের বদলে আপনার অ্যালার্জির উপসর্গ ও লক্ষণ বেড়ে যেতে পারে।
কিডনির কোনো রকম সমস্যা থাকলে তারা অ্যাভোকাডো খাবেন না একেবারেই। কারণ, ফলটিতে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম আছে, যা আপনার স্বাস্থ্যহানী ঘটাতে পারে।
উপসংহার
অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদানে পরিপূর্ণ ফলটি আপনার ডায়েট চার্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠতেই পারে। আগে খেয়ছেন ফলটি? না খেলে, আজ থেকেই শুরু করুন করুন, অ্যাভোকাডো খাওয়ার অভ্যাস। আর জানান আপনার মতামত।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন