সুস্বাস্থ্য ও শারীরিক ভারসাম্য বজায় রাখতে বিশেষজ্ঞরা সবসময়ই ফল খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ফলের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ও বিভিন্ন ধরণের পৌষ্টিক তত্ত্ব থাকে, যা সহজেই আমাদের শরীরে পুষ্টি সরবরাহে সাহায্য করে। স্টাইলক্রেজের এই প্রবন্ধে আমরা সেরকমই একটি ফল অর্থাৎ কামরাঙা নিয়ে আলোচনা করব। এই নিবন্ধের মধ্যে দিয়ে আপনি জানতে পারবেন কামরাঙা ফলের উপকারিতা, ব্যবহার এবং এই ফলের কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে। আর যদি আপনিও নিজেকে সবসময় সুস্থ রাখতে চান, তাহলে অবশ্যই এই প্রবন্ধটি পড়ুন।
চলুন, শুরুতেই জেনে নিই যে কামরাঙা ফলটি আসলে কী?
কামরাঙা কী?
কামরাঙা ফলটি হিন্দিতে কামরখ এবং ইংরেজিতে স্টার ফ্রুট নামে পরিচিত। যখন এই ফলটিকে ছোট ছোট টুকরোয় কাটা হয় তখন তার আকৃতি হয় তারার মতো। তাই এই ফলকে স্টার ফ্রুট বলা হয়ে থাকে। এই ফলটির বিজ্ঞানসম্মত নাম হল এভররোহা কারামবোলা। কামরাঙা ফল সাধারণত হলুদ কিংবা সবুজ রঙের হয়ে থাকে। আর ফল পাকার পর তার রঙ হয়ে যায় হালকা কমলা এবং স্বাদ হয় কিছুটা টক। বাজারে খুব সহজেই এই ফলটি আপনি পেয়ে যাবেন। রাস্তার ধারে ঠ্যালাগাড়িতে করেও অনেককে এই ফলটি বিক্রি করতে দেখা যায়। আসুন এবার জেনে নিই কী কী উপায়ে কামরাঙা ফল আপনার জন্য উপকারী হতে পারে।
কামরাঙা ফলের উপকারিতাঃ
কামরাঙা ফলের মধ্যে থাকে বিভিন্ন ঔষধিগুণ। তাই তা আপনার শরীরের জন্য নানাভাবে ভীষণ উপকারী। এই ফলে আছে ভিটামিন-বি এবং ফাইবারের মতো পুষ্টিগুণ। তাই এটি যেমন আপনার পাচন স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখে, তেমনই স্ট্রোক এবং হার্টের বিভিন্ন রোগের হাত থেকেও আপনাকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। এই ফলের পাতাও পেটের আলসার রোগ সারাতে উপকারী। এমনকি চুলের গোড়া মজবুত করতেও কামরাঙা ফলের জুড়ি মেলা ভার।(১)
এবার চলুন দেখি কী কী ভাবে কামরাঙা ফল আমাদের সাহায্য করে থাকে।
স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কামরাঙা কী কী ভাবে আমাদের সাহায্য করে, সেই বিষয়ে নীচে আলোচনা করা হল।
যদি আপনি আপনার বাড়তে থাকা ওজন নিয়ে সমস্যায় ভুগছেন, তাহলে কামরাঙা ফল আপনার সেই সমাধান করতে সক্ষম। বিশেষজ্ঞদের পেশ করা একটি গবেষণা পত্রে দেখা গিয়েছে যে, কামরাঙা ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইবার পাওয়া যায় কিন্তু ক্যালোরির পরিমাণ থাকে অত্যন্ত কম। তাই সীমিত পরিমাণে কামরাঙা খেলে তা আপনার ওজন কমাতে উপযোগী হবে।
ক্যান্সার রোগকে দূরে রাখতে অনেকেই কামরাঙা ফল খেয়ে থাকেন। আর এটি এই কারণেই সম্ভব কারণ, এতে কিছু পরিমাণে বিটা-ক্যারোটিন থাকে। আর এই বিটা ক্যারোটিন অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।(২) সীমিত পরিমাণ বিটা-ক্যারোটিন খেলে তা আমাদের শরীরের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমায়।(৩)
ডায়াবেটিসের ঝুঁক কমানো নিয়ে পেশ করা একটি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে, কামরাঙা গাছের পাতা থেকে বের হওয়া নির্যাস গ্লুকোজের স্তরকে উন্নত করতে পারে। আর এইভাবে শরীরে গ্লুকোজের স্তরের ভারসাম্য বজায় রেখে তা আপনাকে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষা করে। (৪)
আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রেও কামরাঙা ফলের ঔষধিগুণ ভীষণভাবে কাজে আসে। আর এতি এই কারণেই সম্ভবপর কারণ, কামরাঙায় পর্যাপ্ত পরিমাণে বিটা-ক্যারোটিন পাওয়া যায়। মানবদেহ এই বিটা-ক্যারোটিনকে ভিটামিন-এ’তে বদলে দেয়। আর সেটিই আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া চোখের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যও এটি আমাদের ভীষণ কাজে লাগে।(৫)
কামরাঙা ফল আপনার হজম শক্তি উন্নত করতেও সাহায্য করে। আসলে, ফাইবার যুক্ত ফলগুলির মধ্যে একটি অন্যতম ফল হিসেবে কামরাঙা ফলকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। (৬) আর ফাইবারযুক্ত খাবার খেলে তা আমাদের হজমে দারুন কাজ দেয়, এ তো আমরা সবাই জানি। পাশাপাশি ফাইবারযুক্ত খাবার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করতেও উপযোগী। (৭)
হার্টের স্বাস্থ্যকে উন্নত করতে এবং হার্টের রোগের কারণে আমাদের শরীরে দেখা দেওয়া বিভিন্ন সমস্যার ঝুঁকি কমাতেও কামরাঙা ফল খাওয়া হয়ে থাকে। কামরাঙা ফলে কিছু পরিমাণ ভিটামিন বি-৯ পাওয়া যায়। এটি হার্টের রোগের কারণে আমাদের শরীরে হওয়া বিভিন্ন সমস্যার ঝুঁকি থেকে আমাদের বাঁচাতে সাহায্য করে। এছাড়াও স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি কমাতেও এটি আমাদের সাহায্য করে। এছাড়া কামরাঙা ফলে থাকা ফাইবারও হার্টের রোগ ঠিক করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
উপকারিতা ৮ঃ শ্বাস সম্পর্কিত সমস্যার সমাধানে–
শ্বাস সম্পর্কিত সমস্যার সমাধানেও কামরাঙা খাওয়ার বিভিন্ন ফল দেখতে পাওয়া যায়। আসলে কামরাঙায় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আয়রন, জিংক, ফসফরাস এবং ম্যাগনেশিয়ামের মতো গুণাবলী থাকে। বিজ্ঞানীদের মতে, কামরাঙা খেলে অ্যাজমার মতো শ্বাস সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হয়।
শরীরে রক্তচাপের ভারসাম্য বজায় রাখতে কামরাঙা ভীষণ উপযোগী। কামরাঙায় পর্যাপ্ত পরিমাণে পটাশিয়াম থাকে। আর তা আমাদের শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে খুব সাহায্য করে।
আমাদের শরীরের হাড়ের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতেও কামরাঙা ভীষণ উপযোগী। আমরা সকলেই জানি যে, হাড় মজবুত এবং স্বাস্থ্যবান রাখতে ক্যালসিয়াম ভীষণ জরুরি। আর কামরাঙায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়ামের পুষ্টিগুণ পাওয়া যায়। ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার খেলে তা আপনার শরীরের হাড় মজবুত করে এবং তা ভালো রাখতেও সাহায্য করে।
নীচে আমরা আলোচনা করব ত্বকের উন্নতির ক্ষেত্রে কামরাঙা আমাদের কীভাবে সাহায্য করে।
ত্বক উজ্জ্বল করার জন্য কামরাঙা খেলে তাতে ভালো ফল পাওয়া যায়। আসলে কামরাঙায় ভিটামিন-সি থাকে এবং ভিটামিন-সি আমাদের শরীরে অ্যন্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। তাই ভিটামিন-সি খেলে বা লাগালে তা আমাদের ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে এবং ত্বকের রঙ পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। তাই ভিটামিন-সি মাত্রা পূরণ করতে আপনি কামরাঙা ফল খেলেই লাভবান হবেন।
মুখে ব্রণ’র সমস্যা নিয়ে ভোগেন না, এমন মানুষ দুনিয়ায় খুবই কম রয়েছেন। কারণ আপনার মুখের সৌন্দর্য নষ্ট করতে একটি ব্রণই যথেষ্ট। শরীরে ভিটামিন-সি-এর কমতি দেখা দিলে তা আপনার মুখে ব্রণ সৃষ্টি করার কারণ হতে পারে। আর সেই জায়জায় কামরাঙায় যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন-সি থাকে। তাই এটি খেলে আপনি অচিরেই ব্রণ’র সমস্যার হাত থেকে মুক্তি পাবেন। এছাড়া প্যাক বানিয়ে তা মুখে লাগালেও আপনি এই সমস্যার হাত থেকে রেহাই পেতে পারেন। নীচে পদ্ধতি সম্বন্ধে দেওয়া হল।
উপকরণঃ
ব্যবহারঃ
এবার আমরা আপনাদের জানাব চুলের ক্ষেত্রে কামরাঙা কতটা উপযোগী।
এবার নীচে আমরা আলোচনা করব চুলের স্বাস্থ্যের জন্য কামরাঙা কতখানি উপকারী।
চুল বাড়ানোর ক্ষেত্রেও কামরাঙা ভীশণ উপকারী। আমর আগেই জেনেছি যে, কামরাঙায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-বি পাওয়া যায়। আর ভিটামিন-বি যুক্ত খাবার খেলে তাতে আমাদের চুল গোড়া থেকে মজবুত হয় এবং চুল লম্বাতেও বাড়ে। তাই শরীরে ভিটামিন-বি-এর জোগান পেতে কামরাঙা খেলে লাভ পাওয়া যায়।
খুশকির সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও কামরাঙার ব্যবহার অনস্বীকার্য। আর এটি সম্ভব হয় কারণ, খুশকি দূর করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জিংক। আর কামরাঙায় প্রচুর পরিমাণে জিংক পাওয়া যায়। একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাইয় দেখা গিয়েছে যে, জিংক যুক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করলে চুল থেকে দ্রুত খুশকির সমস্যার সমাধান করা যায়। এছাড়া কামরাঙা দিয়ে একটি প্যাক বানিয়ে চুলে লাগালেও আপনি খুশকির হাত থেকে রেহাই পাবেন। সেই পদ্ধতিটিই নীচে আলোচিত হল।
উপকরণঃ
ব্যবহারঃ
কামরাঙা ফলের উপকারিতা সম্পর্কে জানার পর এবার আমরা জানব এতে মজুদ থাকা এর পুষ্টিগুণগুলি সম্পর্কে।
কামরাঙা ফলের পুষ্টিগুণঃ
কামরাঙা ফলে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিগুণ থাকে। একটি তালিকার মধ্যে দিয়ে আমরা তা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। (৬)
এবার আমরা আলোচনা করব কীভাবে কামরাঙা ফল খাওয়া ও ব্যবহার করা যায়।
কামরাঙা ফলের ব্যবহারঃ
কামরাঙা কীভাবে খাবেন তা নীচে আলোচনা করা হল।
সকালে ফল হিসেবে এবং সন্ধ্যায় সুপ বানিয়ে আপনি কামরাঙা খেতে পারেন। আর রাতে ফ্রুট স্যালাড হিসেবেও আপনি কামরাঙা খেতে পারেন।
একদিনে আপনি মোটামোটি ১৩২ গ্রাম কামরাঙা ফল খেতে পারেন।শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণের কথা মাথায় রেখে এই ফল খাওইয়া উচিত। তাই ভালো হয় যদি এই ফল ঠিক কতটা পরিমাণে খাওয়া উচিত এই বিষয়ে আপনি কোনও খাদ্য বিশেষজ্ঞ বা ডায়াটেশিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
এবার আমরা আপনাদের জানাব এই ফলের কী কী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
কামরাঙা ফলের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াঃ
কামরাঙা ফলের ক্ষতিকর দিকগুলি নিয়ে নীচে আলোচনা করা হল।
এই লেখার মাধ্যমে আপনারা জানলেন যে কামরাঙা ফল খেলে তা কীভাবে আপনাদের বিভিন্ন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ঝুঁকির হাত থেকে বাঁচাতে পারে। আশা করি, এবার আর কামরাঙা ফল দেখে আপনি মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবেন না, বরং অন্তত একবার হলেও এই ফলটি চেখে দেখবেন। যদি পরিমাণ মতো এই ফল আপনি খান, তাহলে অবশ্যই শরীরে উন্নতির লক্ষণ দেখতে পাবেন। এছাড়াও কামরাঙা নিয়ে যদি আপনার আর কোনও রকম প্রশ্ন বা জিজ্ঞাস্য থাকে, তাহলে নীচে দেওয়া কমেন্ট বক্সে তা আমাদের জানান।
এবার চলুন দেখে নিই কামরাঙা নিয়ে মানুষের করা কিছু প্রায়শই জিজ্ঞাস্য প্রশ্ন।
প্রায়শই জিজ্ঞাস্য প্রশ্নঃ
কামরাঙা ফল কি ছাল শুদ্ধ খাওয়া যায়?
হ্যাঁ, এই ফল ছাল শুদ্ধই খাওয়া যায়।
কীকরে বোঝা যাবে যে কামরাঙা ফলটি পেকেছে কি না?
যখন এই ফলটি পেকে যায়, তখন ফলের রং বদলে হয়ে যায় হলুদ। তবে কিছু কিছু জায়গায় হালকা সবুজ এবং খয়েরি রং-ও দেখা যায়। তবে তা স্বাভাবিক।
কামরাঙা ফল কি ফ্রিজে রাখা যায়?
একমাত্র পেকে যাওয়ার পরই এই ফল ফ্রিজে রাখা ভালো। তাছাড়া পাকা ফলটি আপনি ২-৩ দিন পর্যন্ত না ধুয়ে ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রাতেও রেখে দিতে পারবেন। আর ফ্রিজে রাখতে হলে তা ভালো করে প্লাস্টিকে মুড়ে এক সপ্তাহ পর্যন্ত রাখতে পারবেন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন